পারিবারিক আইন ও নারীর অধিকার: সূরা আন-নিসা ১৯-২৪ আয়াতের বিশদ তাফসীর ও বিধান!
আসসালামু আলাইকুম!
আয়াত:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَحِلُّ لَكُمْ أَن تَرِثُوا النِّسَاءَ كَرْهًا ۖ وَلَا تَعْضُلُوهُنَّ لِتَذْهَبُوا بِبَعْضِ مَا آتَيْتُمُوهُنَّ إِلَّا أَن يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُّبَيِّنَةٍ ۚ وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ ۚ فَإِن كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰ أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا
বাংলা অনুবাদ:
"হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য বৈধ নয় যে, তোমরা বলপূর্বক নারীদের উত্তরাধিকারী হবে। আর তোমরা তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করো না যাতে তোমরা তাদেরকে যা দিয়েছ, তার কিছু অংশ কেড়ে নিতে পারো। তবে যদি তারা প্রকাশ্য কোনো অশ্লীল কাজ করে। আর তোমরা তাদের সাথে সদ্ভাবে জীবন যাপন করো। আর যদি তোমরা তাদের অপছন্দও করো, তবে হতে পারে যে, তোমরা এমন কিছু অপছন্দ করছ যাতে আল্লাহ প্রচুর কল্যাণ রেখেছেন।"
বিস্তারিত তাফসির ও বিশ্লেষণ
এই আয়াতটিতে চারটি প্রধান নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা মুসলিম সমাজে স্ত্রী ও নারীর মর্যাদা এবং অধিকারকে নিশ্চিত করে:
১. বলপূর্বক উত্তরাধিকার নিষেধ
* "লা ইয়াহিল্লু লাকুম আন তারিসূ'ন নিসা'আ কারহা": "তোমাদের জন্য বৈধ নয় যে, তোমরা বলপূর্বক নারীদের উত্তরাধিকারী হবে।"
* জাহেলিয়াতের প্রথা বাতিল: ইসলাম-পূর্ব আরবে এমন একটি প্রথা ছিল যে, কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তার সন্তান বা আত্মীয়রা মৃত ব্যক্তির বিধবা স্ত্রীকে নিজেদের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করত। তারা হয় তাকে জোর করে বিবাহ করত অথবা তাকে অন্যত্র বিবাহ করতে বাধা দিত, যতক্ষণ না সে তার মোহরানা বা অন্য সম্পত্তির বিনিময়ে মুক্তি চায়।
* ইসলামের বিধান: আল্লাহ তাআলা এই জঘন্য প্রথাকে স্পষ্টভাবে অবৈধ (হারাম) ঘোষণা করেছেন। স্ত্রী কোনো সম্পত্তি নয়; সে সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং তার স্বামীর মৃত্যুর পর সে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী যেকোনো ব্যক্তিকে বিবাহ করার বা তার জীবন যাপনের পূর্ণ অধিকার রাখে।
২. সম্পদ কেড়ে নিতে দুর্ব্যবহার নিষেধ
* "ওয়া লা তা'দূলূহুন্না লিতাযহাবূ বিবা'দি মা আ-তাইতুমূহুন্না": "আর তোমরা তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করো না যাতে তোমরা তাদেরকে যা দিয়েছ, তার কিছু অংশ কেড়ে নিতে পারো।"
* নিষেধাজ্ঞা: এই আয়াতে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক দিতে বাধ্য করার জন্য মানসিক বা শারীরিক নির্যাতন করতে নিষেধ করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো, যেন স্বামী স্ত্রীকে দেওয়া মোহরানার বা অন্য উপহারের কিছু অংশ ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য স্ত্রীকে কষ্ট না দেয়।
* "তা'দূলু" (تعضلو): এর অর্থ হলো স্ত্রীকে আটকে রাখা, কষ্ট দেওয়া বা তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা।
* ব্যতিক্রম: "ইল্লা আন ইয়া'তীনা বিফাহিশাতিন মুবাইয়্যিনাহ": "তবে যদি তারা প্রকাশ্য কোনো অশ্লীল কাজ করে।"
* যদি স্ত্রী প্রকাশ্য ব্যভিচার বা গুরুতর নৈতিক অপরাধ করে, তবে স্বামী তাকে বাধ্য করতে পারে যে, সে মোহরানার কিছু অংশ ফিরিয়ে দিয়ে খোলার (স্ত্রীর পক্ষ থেকে বিচ্ছেদ) মাধ্যমে সম্পর্ক শেষ করুক। এটা ছাড়া অন্য কোনো কারণে জোর করে স্ত্রীর সম্পদ নেওয়া হারাম।
৩. সদ্ভাবে জীবন যাপন (মা'রুফ)
* "ওয়া আ'শিরূহুন্না বিল মা'রূফ": "আর তোমরা তাদের সাথে সদ্ভাবে জীবন যাপন করো।"
* 'মা'রূফ' (معروف): এর অর্থ হলো সুন্দর, উত্তম, ন্যায়সংগত এবং প্রথাগত ভালো আচরণ।
* বিধান: দাম্পত্য জীবনে স্বামীর দায়িত্ব হলো স্ত্রীর সাথে উত্তম ব্যবহার করা, তার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করা, তার প্রতি ন্যায্য ও সদয় আচরণ করা এবং তার মানবিক চাহিদা ও অধিকার পূরণ করা।
৪. অপছন্দ হলেও ধৈর্য ধারণের উপদেশ
* "ফা ইন কারিহতুমূহুন্না ফা 'আসা আন তাকরাহূ শাইআন ওয়া ইয়াজ'আলাল্লাহু ফীহি খাইরান কাছীরান": "আর যদি তোমরা তাদের অপছন্দও করো, তবে হতে পারে যে, তোমরা এমন কিছু অপছন্দ করছ যাতে আল্লাহ প্রচুর কল্যাণ রেখেছেন।"
* ধৈর্য ও তাকওয়া: আল্লাহ তাআলা স্বামীকে এই উপদেশ দিয়েছেন যে, যদি স্ত্রীর কোনো আচরণ বা গুণ অপছন্দ হয়, তবে ধৈর্য ধারণ করা উচিত। কারণ, মানুষের মন পরিবর্তনশীল এবং আপাতদৃষ্টিতে অপছন্দনীয় কোনো কিছুর মধ্যেও আল্লাহ অগণিত কল্যাণ (খাইরান কাছিরা) লুকিয়ে রাখতে পারেন।
* কল্যাণের ব্যাখ্যা: মুফাসসিরগণ এই কল্যাণের ব্যাখ্যায় বলেন: হতে পারে সেই স্ত্রীর মাধ্যমে নেককার সন্তান জন্ম নেবে, অথবা স্ত্রীর প্রতি ধৈর্য ধারণের মাধ্যমে স্বামী আল্লাহর কাছ থেকে বড় পুরস্কার লাভ করবেন, অথবা দীর্ঘমেয়াদে সেই স্ত্রীর খারাপ দিকটির চেয়ে ভালো দিকটিই বেশি প্রকাশ পাবে।
তাৎপর্যপূর্ণ শিক্ষা ও সারমর্ম
* স্ত্রীর মর্যাদা: ইসলামে স্ত্রী কোনো সম্পত্তি নয়, বরং স্বাধীন মানুষ, যার পূর্ণ অধিকার ও মর্যাদা রয়েছে।
* নৈতিকতা ও আইন: এই আয়াতটি নৈতিক নির্দেশনা (সদ্ভাব) এবং কঠোর আইনি নিষেধাজ্ঞা (জোর করে সম্পদ নেওয়া হারাম) উভয়ই প্রদান করেছে।
* আদর্শ পরিবার: এটি মুসলিম পরিবারে ধৈর্য, উত্তম আচরণ এবং আল্লাহর উপর নির্ভরতার মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করে।
সূরা আন-নিসা: আয়াত ২০
আয়াত:
وَإِنْ أَرَدتُّمُ اسْتِبْدَالَ زَوْجٍ مَّكَانَ زَوْجٍ وَآتَيْتُمْ إِحْدَاهُنَّ قِنطَارًا فَلَا تَأْخُذُوا مِنْهُ شَيْئًا ۚ أَتَأْخُذُونَهُ بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُّبِينًا
বাংলা অনুবাদ:
"আর যদি তোমরা এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করার ইচ্ছা করো, এবং তোমরা তাদের একজনকে প্রচুর সম্পদও দিয়ে থাকো, তবুও তোমরা তার থেকে কিছুই ফিরিয়ে নিও না। তোমরা কি তা মিথ্যা অপবাদ ও সুস্পষ্ট পাপের মাধ্যমে গ্রহণ করবে?"
বিস্তারিত তাফসির ও বিশ্লেষণ
এই আয়াতটি স্ত্রীর মোহরানা ও তার প্রদত্ত সম্পদের ওপর তার পূর্ণ অধিকারকে নিশ্চিত করেছে, বিশেষ করে যখন স্বামী নিজেই বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়।
১. অন্য স্ত্রী গ্রহণের ইচ্ছা (তালাকের প্রেক্ষাপট)
* "ওয়া ইন আরাদতুমু'স তিবদা-লা যাওজিম মাক্বা-না যাওজ": "আর যদি তোমরা এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করার ইচ্ছা করো।"
* তালাকের কারণ: এই বাক্যটি এমন পরিস্থিতিকে নির্দেশ করে, যখন স্বামী প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিতে চায় (অথবা অন্য কারণে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায়) এবং তার বদলে অন্য কোনো নারীকে বিবাহ করতে মনস্থির করে।
* ইচ্ছার স্বাধীনতা: স্বামীর তালাক দেওয়ার বা অন্য নারীকে বিবাহ করার ইচ্ছা থাকলেও, এই আয়াতে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, এই ইচ্ছা স্ত্রীর আর্থিক অধিকারকে কোনোভাবে ক্ষুণ্ণ করতে পারে না।
২. মোহরানা ফিরিয়ে নেওয়ার নিষেধাজ্ঞা
* "ওয়া আ-তাইতুম ইহদাহুন্না ক্বিনত্বা-রা- ফালা তা'খুযূ মিনহু শাই'আ": "এবং তোমরা তাদের একজনকে প্রচুর সম্পদও দিয়ে থাকো, তবুও তোমরা তার থেকে কিছুই ফিরিয়ে নিও না।"
* ক্বিনত্বার (قنطارا): এই শব্দটি প্রচুর সম্পদ, বিপুল পরিমাণ অর্থ বা সোনার স্তূপকে বোঝায়। এর ব্যবহারের উদ্দেশ্য হলো: যদি স্বামী স্ত্রীকে পাহাড়সমান সম্পদও মোহরানা হিসেবে দিয়ে থাকে, তবুও বিবাহবিচ্ছেদের সময় তা থেকে এক কণা পরিমাণও ফিরিয়ে নেওয়া বৈধ নয়।
* বিধান: এই নিষেধাজ্ঞাটি সেই স্বামীর জন্য, যে নিজের পক্ষ থেকে তালাকের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এবং স্ত্রীর কাছ থেকে মোহরানা ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য কোনো অজুহাত খুঁজছে।
৩. মিথ্যা অপবাদ ও পাপের মাধ্যমে গ্রহণ নিষেধ
* "আ তা'খুযূনাহূ বুহতা-নান ওয়া ইছমাম মুবীনান": "তোমরা কি তা মিথ্যা অপবাদ ও সুস্পষ্ট পাপের মাধ্যমে গ্রহণ করবে?"
* বুহতান (بهتانا): এটি মিথ্যা অপবাদ, জঘন্য অপবাদ বা প্রতারণাকে বোঝায়।
* ইসমান মুবীনান (إثما مبينا): এটি সুস্পষ্ট পাপ।
* কঠোর হুঁশিয়ারি: এই বাক্যটি অত্যন্ত কঠোরভাবে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর সম্পদ ফিরিয়ে নেওয়ার প্রবণতাকে তিরস্কার করে। স্বামী যদি সম্পদ ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য স্ত্রীর ওপর কোনো মিথ্যা অপবাদ (যেমন: ব্যভিচার বা খারাপ আচরণের মিথ্যা অভিযোগ) আরোপ করে, তবে তা হবে আল্লাহ্র দৃষ্টিতে দ্বিগুণ অপরাধ—সম্পদ আত্মসাৎ এবং মিথ্যা অপবাদ।
তাফসিরে ইবনে কাসির ও অন্যান্য তাফসিরের সারমর্ম
* স্ত্রীর মালিকানা নিশ্চিত: এই আয়াতটি আবারও নিশ্চিত করে যে, মোহরানা হলো স্ত্রীর নিজস্ব সম্পত্তি এবং এর ওপর তার পূর্ণ মালিকানা রয়েছে। তালাকের কারণে স্ত্রী তার মোহরানার অধিকার হারায় না।
* ন্যায়সঙ্গততা: আল্লাহ তাআলা এই বিধানের মাধ্যমে নারীদেরকে স্বামীর জুলুম ও প্রতারণা থেকে রক্ষা করেছেন। স্বামী যদি নিজেই স্ত্রীকে পছন্দ না করে তালাক দিতে চায়, তবে এর দায়ভার সম্পূর্ণভাবে স্বামীর এবং স্ত্রীর প্রাপ্য সম্পূর্ণভাবে তার থাকবে।
* অন্যান্য আয়াতের সম্পর্ক: এই আয়াতটি ১৯নং আয়াতের (যেখানে বলা হয়েছে, শুধু প্রকাশ্য অশ্লীলতা ছাড়া দুর্ব্যবহার করে সম্পদ কেড়ে নেওয়া যাবে না) বক্তব্যকে আরও দৃঢ় করে এবং স্বামীর লোভ ও অন্যায়কে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করে।
এই আয়াতটি পারিবারিক ও আর্থিক ন্যায়বিচারে ইসলামের কঠোর অবস্থানকে প্রতিফলিত করে।
সূরা আন-নিসা: আয়াত ২১
আয়াত:
وَكَيْفَ تَأْخُذُونَهُ وَقَدْ أَفْضَىٰ بَعْضُكُمْ إِلَىٰ بَعْضٍ وَأَخَذْنَ مِنكُم مِّيثَاقًا غَلِيظًا
বাংলা অনুবাদ:
"আর তোমরা তা (মোহরানা/সম্পদ) কীভাবে ফিরিয়ে নেবে, যখন তোমাদের একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠতা লাভ হয়েছে, আর তারা (স্ত্রীরা) তোমাদের থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করেছে?"
ব্যাখ্যা (তাফসির)
এই আয়াতটি আগের ২০ নম্বর আয়াতেরই ধারাবাহিকতা, যেখানে স্বামীকে তালাকের সময় স্ত্রীর মোহরানা বা অন্য কোনো সম্পদ ফিরিয়ে নিতে নিষেধ করা হয়েছিল। এখানে আল্লাহ তাআলা মোহরানা ফিরিয়ে নেওয়াকে অবৈধ ঘোষণা করার দুটি শক্তিশালী কারণ তুলে ধরেছেন:
১. ঘনিষ্ঠতা ও দাম্পত্য সম্পর্ক (আফদ্বা বা'দুকুম ইলা বা'দ)
* "ওয়া কাইফা তা'খুযূনাহু ওয়া ক্বাদ আফদ্বা বা'দুকুম ইলা বা'দ": "আর তোমরা তা (সম্পদ) কীভাবে ফিরিয়ে নেবে, যখন তোমাদের একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠতা লাভ হয়েছে?"
* 'আফদ্বা' (أفضى): এই শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো 'গোপনীয়তা প্রকাশ করা' বা 'একা থাকা'। বিবাহিত জীবনের প্রসঙ্গে এর অর্থ হলো শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন ও ঘনিষ্ঠতা লাভ করা।
* তাৎপর্য: আল্লাহ তাআলা স্বামীকে প্রশ্ন করছেন, তোমরা কীভাবে সেই স্ত্রীর কাছ থেকে তার সম্পদ ফিরিয়ে নিতে চাও, যার সাথে তোমরা গভীরতম ও একান্ত সম্পর্ক স্থাপন করেছ? এই সম্পর্ক এমন এক বন্ধন তৈরি করে, যার পর মোহরানা ফিরিয়ে নেওয়ার চিন্তা করা চরম অন্যায়, অকৃতজ্ঞতা এবং নির্লজ্জতা। এই ঘনিষ্ঠতার বিনিময়েই স্ত্রী তার জীবন, আস্থা ও গোপনীয়তাকে স্বামীর কাছে সমর্পণ করে।
২. দৃঢ় অঙ্গীকার বা কঠিন চুক্তি (মীছাক্বান গালীযা)
* "ওয়া আখাযনা মিনকুম মীছাক্বান গালীযা": "আর তারা (স্ত্রীরা) তোমাদের থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার (বা কঠিন চুক্তি) গ্রহণ করেছে।"
* মীছাক্বান গালীযা (ميثاقًا غليظًا): এটি একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ শব্দগুচ্ছ, যা দিয়ে 'কঠোর, দৃঢ় ও গুরুতর অঙ্গীকার' বোঝানো হয়।
* মুফাসসিরদের ব্যাখ্যা: এই 'দৃঢ় অঙ্গীকার' দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে, তা নিয়ে একাধিক মত রয়েছে, তবে সব মতই এর গুরুত্বকে তুলে ধরে:
* আল্লাহ্র নামে অঙ্গীকার: অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে, বিবাহ বন্ধন এমন একটি চুক্তি যা আল্লাহর বিধান, তাঁর নাম এবং তাঁর সাক্ষী হিসেবে সংঘটিত হয়। স্বামী ও স্ত্রী আল্লাহর নামে একে অপরের অধিকার পূরণের অঙ্গীকার করে।
* ভোগের অধিকার ও দায়িত্ব: এই অঙ্গীকারের মাধ্যমে স্বামী বৈধভাবে স্ত্রীর থেকে উপভোগের অধিকার পায়, তবে এর বিনিময়ে স্ত্রীর প্রতি সকল দায়িত্ব (মোহরানা, ভরণপোষণ, সুরক্ষা) পালনের কঠিন অঙ্গীকারও করে।
* তাৎপর্য: কুরআনের অন্যান্য স্থানে এই 'মীছাক্বান গালীযা' শব্দটি শুধুমাত্র নবী-রাসূলদের কাছ থেকে আল্লাহ্র নেওয়া কঠিন অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। বিবাহ বন্ধনে এই শব্দটি ব্যবহার করে আল্লাহ তাআলা দাম্পত্য চুক্তির ধর্মীয় ও নৈতিক গুরুত্বকে সর্বোচ্চ স্থানে স্থাপন করেছেন। এটি প্রমাণ করে যে, বিবাহ কোনো সাধারণ লেনদেন বা চুক্তি নয়, বরং আল্লাহ্র সামনে করা একটি পবিত্র শপথ।
আয়াতের মূল শিক্ষা
* মোহরানা পবিত্র: মোহরানা কোনো অস্থায়ী উপহার বা জামানত নয় যা তালাকের সময় ফিরিয়ে নেওয়া যাবে; বরং এটি দাম্পত্য সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা এবং আল্লাহ্র নামে করা চুক্তির বিনিময়ে দেওয়া হয়।
* নৈতিক চাপ: আল্লাহ তাআলা স্বামীর ওপর নৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছেন যে, এত গভীর সম্পর্ক ও পবিত্র চুক্তির পর কোনো প্রকার অজুহাতে স্ত্রীর সম্পদ আত্মসাৎ করা অমানবিক ও পাপের কাজ।
* স্ত্রীর সুরক্ষা: এই আয়াতটি আবারও নারীর আর্থিক অধিকার ও মর্যাদাকে নিশ্চিত করে এবং স্বামীকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে।
সূরা আন-নিসা: আয়াত ২২
আয়াত:
وَلَا تَنكِحُوا مَا نَكَحَ آبَاؤُكُم مِّنَ النِّسَاءِ إِلَّا مَا قَدْ سَلَفَ ۚ إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَمَقْتًا وَسَاءَ سَبِيلًا
বাংলা অনুবাদ:
"আর তোমরা সেই নারীদেরকে বিবাহ করো না, যাদেরকে তোমাদের পিতারা বিবাহ করেছে—তবে যা অতীতে (ইসলাম-পূর্ব যুগে) ঘটে গেছে। নিশ্চয়ই এটি ছিল প্রকাশ্য অশ্লীলতা, চরম ঘৃণ্য কাজ ও নিকৃষ্ট পন্থা।"
বিস্তারিত তাফসির ও বিশ্লেষণ
এই আয়াতটি একটি বিশেষ ধরনের বিবাহকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং এই নিষেধাজ্ঞাটি পারিবারিক পবিত্রতা ও নৈতিকতার ভিত্তি স্থাপন করেছে।
১. পিতার স্ত্রীকে বিবাহ করার নিষেধাজ্ঞা
* "ওয়া লা তানকিহূ মা নাকাহা আ-বা-উকুম মিনান নিসা'ই": "আর তোমরা সেই নারীদেরকে বিবাহ করো না, যাদেরকে তোমাদের পিতারা বিবাহ করেছে।"
* হারাম ঘোষণা: ইসলাম-পূর্ব যুগে (জাহেলিয়াতে) প্রথা ছিল যে, কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তার সন্তান (বিশেষত বড় ছেলে) তার সৎ-মাতাকে (পিতার স্ত্রীকে) বিবাহ করতে পারত বা তাকে অন্য কোথাও বিবাহ করতে বাধা দিয়ে তার সম্পত্তির মতো অধিকার খাটাত। এই প্রথাকে আরবিতে 'মাকত' (মৃক্ত) বা 'ঘৃণ্য কাজ' বলা হতো।
* বিধান: এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা এই ঘৃণ্য প্রথাকে স্পষ্টভাবে চিরতরে হারাম (নিষিদ্ধ) ঘোষণা করেছেন। পিতার স্ত্রী, যিনি সন্তানের সৎ-মাতা, তিনি মায়ের মর্যাদার সমান, তাঁর সাথে কোনো সন্তানের বিবাহ বৈধ নয়।
২. অতীত কাজের বৈধতা নয়, ক্ষমা
* "ইল্লা মা ক্বাদ সালাফ": "তবে যা অতীতে (ইসলাম-পূর্ব যুগে) ঘটে গেছে।"
* তাৎপর্য: এই বাক্যটি এই নয় যে, ভবিষ্যতে এই কাজ বৈধ। বরং এর অর্থ হলো, ইসলাম গ্রহণের আগে যারা অজ্ঞতাবশত এই কাজ করেছে, ইসলাম তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছে এবং তাদের শাস্তি হবে না। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর এই বিবাহ বহাল রাখা যাবে না এবং অবিলম্বে তা বাতিল করতে হবে।
* রহমতের দরজা: এই বিধানটি আল্লাহর রহমতের অংশ। তিনি অতীতের অপরাধ ক্ষমা করে নতুন ও পবিত্র জীবন শুরু করার সুযোগ দিয়েছেন।
৩. এই কাজের গুরুতরতা
আল্লাহ তাআলা এই কাজটিকে বর্ণনা করার জন্য তিনটি কঠোর শব্দ ব্যবহার করেছেন:
* ফাহিশাতান (فَاحِشَةً): এটি প্রকাশ্য অশ্লীলতা বা জঘন্য পাপ। এটি এতটাই জঘন্য যে, সমাজেও এটিকে পাপ হিসেবে গণ্য করা হতো। এই শব্দটি ব্যভিচারের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়, যা এর ভয়াবহতাকে নির্দেশ করে।
* মাক্বতান (وَمَقْتًا): এর অর্থ হলো চরম ঘৃণা বা আল্লাহ্র ক্রোধের কারণ। এই অপরাধটি শুধু জঘন্যই নয়, আল্লাহ তাআলার কাছেও এটি অত্যন্ত ঘৃণ্য ও তাঁর ক্রোধের কারণ।
* ওয়া সা'আ সাবীলা (وَسَاءَ سَبِيلًا): এর অর্থ হলো নিকৃষ্ট পন্থা বা মন্দ পথ। অর্থাৎ, এটি একটি এমন পথ যা মানুষকে ধ্বংস ও চারিত্রিক অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যায় এবং পারিবারিক পবিত্রতাকে নষ্ট করে দেয়।
তাফসিরে ইবনে কাসির ও অন্যান্য তাফসিরের সারমর্ম
* পারিবারিক পবিত্রতা: এই আয়াতটি ইসলামে পারিবারিক সম্পর্ক ও পবিত্রতার গুরুত্বকে তুলে ধরে। মা-বাবার মতো পবিত্র সম্পর্কের মর্যাদাকে রক্ষা করা ইসলামের একটি মৌলিক নীতি।
* শারিয়তের সংস্কার: এটি ইসলাম কর্তৃক জাহেলিয়াতে প্রচলিত একটি কুপ্রথাকে বাতিল করে সমাজের নৈতিক ভিত্তি দৃঢ় করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ।
* সর্বজনীন নীতি: ইসলামী শরিয়তে এমন সকল বিবাহ নিষিদ্ধ, যা রক্তের সম্পর্ক, দুগ্ধপানের সম্পর্ক বা বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে পবিত্রতা লাভ করে (যেমন: সৎ-মা)।
এই আয়াতটি মুসলিমদেরকে তাদের পারিবারিক বন্ধনকে সম্মান করতে এবং অশ্লীলতা ও নৈতিক অবক্ষয় থেকে দূরে থাকতে উৎসাহিত করে।
সূরা আন-নিসা: আয়াত ২৩
আয়াত:
حُرِّمَتْ عَلَيْكُمْ أُمَّهَاتُكُمْ وَبَنَاتُكُمْ وَأَخَوَاتُكُمْ وَعَمَّاتُكُمْ وَخَالَاتُكُمْ وَبَنَاتُ الْأَخِ وَبَنَاتُ الْأُخْتِ وَأُمَّهَاتُكُمُ اللَّاتِي أَرْضَعْنَكُمْ وَأَخَوَاتُكُم مِّنَ الرَّضَاعَةِ وَأُمَّهَاتُ نِسَائِكُمْ وَرَبَائِبُكُمُ اللَّاتِي فِي حُجُورِكُم مِّن نِّسَائِكُمُ اللَّاتِي دَخَلْتُم بِهِنَّ فَإِن لَّمْ تَكُونُوا دَخَلْتُم بِهِنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ وَحَلَائِلُ أَبْنَائِكُمُ الَّذِينَ مِنْ أَصْلَابِكُمْ وَأَن تَجْمَعُوا بَيْنَ الْأُخْتَيْنِ إِلَّا مَا قَدْ سَلَفَ ۗ إِنَّ اللَّهَ كَانَ غَفُورًا رَّحِيمًا
বাংলা অনুবাদ:
"তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ (হারাম) করা হয়েছে: ১. তোমাদের মাতারা, ২. তোমাদের কন্যারা, ৩. তোমাদের বোনেরা, ৪. তোমাদের ফুফুরা, ৫. তোমাদের খালা-মৌসীরা, ৬. ভাইয়ের কন্যারা (ভাতিজি), ৭. বোনের কন্যারা (ভাগ্নি)। এবং [দুগ্ধ-সম্পর্কের কারণে]: ৮. তোমাদের সেই মাতারা যারা তোমাদের দুধ পান করিয়েছেন, ৯. দুধ-সম্পর্কের কারণে তোমাদের বোনেরা। এবং [বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে]: ১০. তোমাদের স্ত্রীদের মাতারা (শাশুড়ি), ১১. তোমাদের সেই স্ত্রীর কন্যা (সৎ-কন্যা) যারা তোমাদের তত্ত্বাবধানে আছে, যাদের সাথে তোমরা সহবাস করেছ; তবে যদি সহবাস না করে থাকো, তবে তোমাদের কোনো দোষ নেই (তালাকের পর তাদের বিবাহ করা বৈধ)। ১২. তোমাদের ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রীদেরকে। এবং (একই সাথে): ১৩. একই সাথে দুই বোনকে বিবাহ করা (নিষিদ্ধ করা হয়েছে), তবে যা অতীতে ঘটে গেছে। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।"
তাফসির: বিবাহের নিষিদ্ধতা ও এর মূলনীতি
এই আয়াতটি মূলত মুহাররামাত (المحرمات) বা বিবাহে চিরতরে নিষিদ্ধ নারীদের তালিকা দেয়। এই নিষেধাজ্ঞাগুলো পারিবারিক বন্ধনের পবিত্রতা, নৈতিকতা এবং বংশধারা রক্ষার ভিত্তি।
১. রক্তের কারণে নিষিদ্ধতা (মুহাররামা-ত বি-নাসাব)
রক্তের সম্পর্কের কারণে সাত শ্রেণীর নারীকে চিরতরে হারাম করা হয়েছে। এদের মধ্যে কোনো প্রকার সন্দেহ বা শিথিলতা নেই।
* মাতৃস্থানীয়: এতে জন্মদাত্রী মা, দাদী, নানী, ওপরে যত প্রজন্মের নারী আছেন—সবাই অন্তর্ভুক্ত।
* কন্যাস্থানীয়: এতে জন্মদাত্রী কন্যা, নাতনী, পৌত্রী—নিচে যত প্রজন্মের নারী আছেন—সবাই অন্তর্ভুক্ত।
* সহোদর বা সমান্তরাল: এতে বোন (আপন, বৈমাত্রেয় বা বৈপিত্রেয়), ফুফু (পিতার সব বোন) এবং খালা (মাতার সব বোন) অন্তর্ভুক্ত। এই সম্পর্কগুলো এতটাই ঘনিষ্ঠ যে তাদের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ।
* ভাইপো/ভাগ্নেস্থানীয়: এতে ভাতিজি (ভাইয়ের কন্যা) এবং ভাগ্নি (বোনের কন্যা) অন্তর্ভুক্ত। এরা নিজের কন্যাকেন্দ্রিক সম্পর্কের মতো।

২. দুগ্ধপানের কারণে নিষিদ্ধতা (মুহাররামা-ত বি-রাদা'আত)
দুধের সম্পর্ককে আল্লাহ তাআলা রক্তের সম্পর্কের মতো গণ্য করেছেন।
* দুধ মা: যে নারী নির্ধারিত সময়ে দুধ পান করিয়েছেন।
* দুধ বোন: দুধ মায়ের কন্যা বা দুধ পানের মাধ্যমে সৃষ্ট অন্যান্য নারী আত্মীয়।

৩. বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে নিষিদ্ধতা (মুহাররামা-ত বি-মুসাহারা)
বিয়ের মাধ্যমে যে সম্পর্ক তৈরি হয়, তা স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধতার সৃষ্টি করে।
* স্ত্রীর মা (শাশুড়ি): বিবাহ চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথেই শাশুড়ি চিরতরে হারাম হয়ে যান, স্ত্রীর সাথে সহবাস হোক বা না হোক।
* স্ত্রীর কন্যা (সৎ-কন্যা বা রবাব): এটি একটি শর্তযুক্ত নিষেধাজ্ঞা।
* সহবাসের শর্ত: স্ত্রীর সাথে সহবাস (দخول) সম্পন্ন হলে তার পূর্ববর্তী পক্ষের কন্যা চিরতরে হারাম হয়ে যায়।
* সহবাস না হলে: যদি স্ত্রীকে সহবাসের আগেই তালাক দেওয়া হয়, তবে স্বামীকে সেই সৎ-কন্যাকে বিবাহ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
* পুত্রের স্ত্রী (পুত্রবধূ): ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রী (পুত্রের সাথে বিবাহ চুক্তি হওয়ার পর) চিরতরে হারাম।
মূলনীতি: এই বিধানগুলো শ্বশুর-শাশুড়ি, পুত্রবধূ এবং সৎ-কন্যার মতো অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্কগুলিতে সম্মানের একটি সীমারেখা টানে।
৪. সাময়িক কারণে নিষিদ্ধতা (হারামে মুয়াক্কাত)
আয়াতে আরেকটি বিশেষ ধরনের নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে, যা চিরস্থায়ী নয়, বরং নির্দিষ্ট সময় বা শর্তে প্রযোজ্য:
* একই সাথে দুই বোনকে বিবাহ করা: একই সময়ে দুই সহোদর বা অন্য কোনো প্রকার বোনকে বিবাহ করা নিষিদ্ধ।
মূলনীতি: এই নিষেধাজ্ঞার কারণ হলো, দুই বোনকে একই সাথে বিবাহ করলে তাদের মধ্যে ঈর্ষা ও দ্বেষ সৃষ্টি হতে পারে, যা তাদের পারিবারিক বন্ধনকে নষ্ট করে দিতে পারে। তবে এক বোনের মৃত্যু হলে বা তাকে তালাক দেওয়ার পর ইদ্দতকাল পার হলে অন্য বোনকে বিবাহ করা বৈধ।
৫. অতীত ক্ষমার ঘোষণা
* "ইল্লা মা ক্বাদ সালাফ": এখানেও ঘোষণা করা হয়েছে যে, ইসলাম গ্রহণের পূর্বে অজ্ঞতাবশত যদি কেউ এই নিষিদ্ধ কাজ করে থাকে, তবে আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং তাদের নতুন জীবন শুরু করার সুযোগ দিয়েছেন।
* "ইন্নাল্লাহা কা-না গাফূরার রাহীমা": আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি ক্ষমাশীল (গাফূর) এবং পরম দয়ালু (রাহীম)। এই ঘোষণাটি মানুষের প্রতি তাঁর অসীম দয়া ও ভালোবাসাকে প্রকাশ করে।
সারসংক্ষেপ: এই আয়াতটি ইসলামের পারিবারিক আইনের একটি স্তম্ভ। এটি শুধু বৈধতা বা অবৈধতার তালিকা নয়, বরং পারিবারিক পবিত্রতা, নৈতিকতা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে দেওয়া একটি পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন।
সূরা আন-নিসা: আয়াত ২৪
আয়াত:
وَالْمُحْصَنَاتُ مِنَ النِّسَاءِ إِلَّا مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ۖ كِتَابَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ ۚ وَأُحِلَّ لَكُم مَّا وَرَاءَ ذَٰلِكُمْ أَن تَبْتَغُوا بِأَمْوَالِكُم مُّحْصِنِينَ غَيْرَ مُسَافِحِينَ ۚ فَمَا اسْتَمْتَعْتُم بِهِ مِنْهُنَّ فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ فَرِيضَةً ۚ وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا تَرَاضَيْتُم بِهِ مِن بَعْدِ الْفَرِيضَةِ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا
বাংলা অনুবাদ:
"আর বিবাহিত নারীরাও (তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ), তবে তোমাদের ডান হাত যাদের মালিক হয়েছে (অর্থাৎ দাসী) তারা ছাড়া। এটি তোমাদের ওপর আল্লাহ্র লিখিত বিধান। আর তোমাদের জন্য এগুলোর পরবর্তী নারীরা হালাল করা হয়েছে, (যদি) তোমরা তোমাদের সম্পদের বিনিময়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হও, পাপ কাজ করার জন্য নয়। অতঃপর তাদের মধ্য থেকে যাদের সাথে তোমরা উপভোগ করেছ, তাদেরকে তাদের নির্ধারিত মোহরানা প্রদান করো। আর নির্ধারিত মোহরানা প্রদানের পর তোমরা পারস্পরিক সম্মতিতে যা স্থির করো, তাতে তোমাদের কোনো দোষ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।"
বিস্তারিত তাফসির ও বিধান
এই আয়াতটি তিনটি প্রধান বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করে: বিবাহের মাধ্যমে নিষিদ্ধ নারী, সাধারণ বিবাহের বৈধতা এবং মোহরানা পরিশোধের গুরুত্ব।
১. বিবাহিত নারী (মুহসানাত) এবং দাসীর বিধান
* "ওয়াল মুহসানাতু মিনান নিসা'ই ইল্লা মা মালাকাত আইমানুকুম": "আর বিবাহিত নারীরাও (তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ), তবে তোমাদের ডান হাত যাদের মালিক হয়েছে (অর্থাৎ দাসী) তারা ছাড়া।"
* মুহসানাত (المحصنات): এই শব্দটি তিন অর্থে ব্যবহৃত হয়: ১. বিবাহিত নারী, ২. সচ্চরিত্রা নারী, ৩. স্বাধীন নারী। এখানে সাধারণত বিবাহিত নারীকেই বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, অন্য কোনো পুরুষের বিবাহিত নারীকে বিবাহ করা হারাম।
* দাসীর বিধান: "ইল্লা মা মালাকাত আইমানুকুম" (তবে তোমাদের ডান হাত যাদের মালিক হয়েছে)। এর অর্থ হলো, যুদ্ধ বা অন্য বৈধ পন্থায় প্রাপ্ত বিবাহিত দাসী যদি তাদের স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বা তাদের দাসত্বের মালিকানা পরিবর্তিত হয়, তবে সেই দাসীর সাথে তার নতুন মালিকের যৌন সম্পর্ক স্থাপন বৈধ হতে পারে। (এটি দাসপ্রথা থাকা কালীন সময়ের বিধান, যা বর্তমান বিশ্বে প্রযোজ্য নয়)।
* "কিতাবা'ল্লাহি আলাইকুম": "এটি তোমাদের ওপর আল্লাহ্র লিখিত বিধান।"
* এই বিধানগুলো মানুষের রচিত নয়, বরং আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আবশ্যিক ও লিখিত আইন।
২. সাধারণ বিবাহের বৈধতা ও শর্তাবলী
* "ওয়া উহিল্লা লাকুম মা ওয়ার-আ যালিকুম": "আর তোমাদের জন্য এগুলোর পরবর্তী নারীরা হালাল করা হয়েছে।"
* অনুমতি: ২৩ ও ২৪ আয়াতে যে নারীদেরকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে, তারা ব্যতীত সকল নারীকে বিবাহ করা বৈধ।
* "আন তাবতাগূ বি-আমওয়ালিকুম মুহসিনীন গায়রা মুসাফিহীন": "তোমরা তোমাদের সম্পদের বিনিময়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হও, পাপ কাজ করার জন্য নয়।"
* শর্ত:
* অর্থের বিনিময়ে: বিবাহের জন্য অবশ্যই মোহরানা (আমওয়াল) দিতে হবে।
* উদ্দেশ্য: বিবাহের উদ্দেশ্য হতে হবে সচ্চরিত্র রক্ষা করা (মুহসিনীন)।
* অবৈধতা পরিহার: বিবাহ যেন ব্যভিচার বা অবৈধ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য না হয় (গায়রা মুসাফিহীন)।
৩. মোহরানা এবং মুতা'আহ'র বিধান
* "ফামা'স তামতা'তুম বিহী মিনহুন্না ফা আ-তূহুন্না উজূরাহুন্না ফারীদ্বাহ": "অতঃপর তাদের মধ্য থেকে যাদের সাথে তোমরা উপভোগ করেছ, তাদেরকে তাদের নির্ধারিত মোহরানা প্রদান করো।"
* উপভোগ (ইস্তামতা'): মুফাসসিরদের মধ্যে এই অংশের দুটি প্রধান ব্যাখ্যা প্রচলিত:
* সাধারণ বিবাহ: এটি সাধারণ বিবাহের চুক্তিতে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনকে বোঝায়। সহবাসের পর মোহরানা প্রদান করা আবশ্যিক (ফরজ) হয়ে যায়।
* মুতা'আহ (সাময়িক বিবাহ): এটি বিবাহের একটি নির্দিষ্ট রূপ ছিল, যা ইসলাম প্রবর্তনের প্রথম দিকে অস্থায়ীভাবে বৈধ ছিল। এই ব্যাখ্যার মতে, আয়াতটি মুতা'আহ-এর জন্য একটি বিধান দিয়েছিল, যেখানে চুক্তির সময়সীমা শেষ হওয়ার পর স্ত্রীকে তার নির্ধারিত পারিশ্রমিক (যা এখানে 'উজুর' বা মোহরানা হিসেবে ব্যবহৃত) পরিশোধ করতে হবে। তবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা'আতের ঐকমত্য হলো, রাসূল (সা.) খায়বার বিজয়ের সময় মুতা'আহ-কে চিরতরে হারাম (নিষিদ্ধ) ঘোষণা করেছেন।
* চূড়ান্ত মত: এই আয়াতটি সাধারণ বিবাহের চুক্তিকেই নির্দেশ করে, যেখানে সহবাস বা উপভোগের পর স্ত্রীকে তার পূর্ণ মোহরানা পরিশোধ করা আবশ্যক।
* "ওয়া লা জুনাহা আলাইকুম ফীমা তারা-দ্বাইতুম বিহী মিম বা'দি'ল ফারীদ্বাহ": "আর নির্ধারিত মোহরানা প্রদানের পর তোমরা পারস্পরিক সম্মতিতে যা স্থির করো, তাতে তোমাদের কোনো দোষ নেই।"
* পরিবর্তনের সুযোগ: মোহরানা একবার নির্ধারিত হওয়ার পরও, স্বামী-স্ত্রী যদি পরস্পরের সম্মতিতে তা পরিবর্তন বা হ্রাস-বৃদ্ধি করতে চায়, তবে তাতে কোনো বাধা নেই। যেমন—স্ত্রী তার স্বামীকে কিছু মোহরানা ছেড়ে দিতে পারে বা স্বামী স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত দিতে পারে।
* "ইন্নাল্লাহা কা-না 'আলীমান হাকীমা": "নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।"

سُبْحَانَ اللَّهِ – আল্লাহ পবিত্র ও মহান।
ٱلْحَمْدُ لِلَّهِ – সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
لَا إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّهُ – আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই।
ٱللَّهُ أَكْبَرُ – আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ।
أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ – আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই।
---


لَا إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّهُ مُحَمَّدٌ رَّسُولُ ٱللَّهِ
"আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল
0 Comments