জাহান্নামের কঠিন শাস্তি
ভূমিকা
মানবজীবনের শেষ ঠিকানা দু’টি—জান্নাত কিংবা জাহান্নাম। আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য জান্নাত সৃষ্টি করেছেন, যেখানে চিরস্থায়ী শান্তি ও সুখ বিরাজমান। অন্যদিকে যারা আল্লাহর অবাধ্য, কুফরি, শিরক ও পাপাচারে লিপ্ত থাকবে তাদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে জাহান্নাম। কুরআন ও হাদিসে জাহান্নামের শাস্তির ভয়াবহ বর্ণনা এসেছে, যা প্রতিটি ঈমানদারের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করে। এই প্রবন্ধে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি নিয়ে আলোচনা করা হলো।
জাহান্নামের অস্তিত্ব
জাহান্নামের অস্তিত্ব আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে অকাট্য সত্য। কুরআনে তিনি বলেছেন—
“যারা কুফরি করবে তাদের জন্য জাহান্নামের আগুন রয়েছে।” (সূরা ফাতির: ৩৬)
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন—
“তোমাদের দুনিয়ার আগুন যা মানুষ জ্বালায়, তা জাহান্নামের আগুনের এক অংশমাত্র। জাহান্নামের আগুন তা থেকে আরও ৭০ গুণ বেশি তীব্র।” (বুখারি, মুসলিম)
জাহান্নামের অধিবাসীরা কারা?
কুরআন ও হাদিসে স্পষ্ট বলা হয়েছে, কারা জাহান্নামের অধিবাসী হবে:
- যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে এবং শিরক করে।
- নামাজ, রোজা, জাকাত ত্যাগকারীরা।
- সুদখোর, মদ্যপায়ী ও ব্যভিচারীরা।
- মুনাফিক ও দ্বিমুখী লোকেরা।
- পিতামাতার অবাধ্য এবং অন্যায়ের পথে চলা ব্যক্তিরা।
জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তি
- চামড়ার পুনঃপুন পরিবর্তন
আল্লাহ বলেন—
“যখন তাদের চামড়া পুড়ে যাবে তখন আমি তাদের আরেকটি চামড়া বদলে দেব, যাতে তারা শাস্তির স্বাদ পেতে থাকে।” (সূরা নিসা: ৫৬) - ফুটন্ত পানি পান করানো
তাদেরকে এমন ফুটন্ত পানি পান করানো হবে যা তাদের অন্ত্র-উদর ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে। (সূরা মুহাম্মদ: ১৫) - যাক্কুম গাছের ফল
এটি হবে জাহান্নামীদের খাদ্য, যা পেটে ফুটন্ত তেলের মতো জ্বলবে। (সূরা দুখান: ৪৩-৪৬) - লোহার শৃঙ্খল ও শিকল
জাহান্নামীদের ঘাড়ে শিকল পরিয়ে টেনে নেওয়া হবে। (সূরা গাফির: ৭১-৭২) - কালো ধোঁয়া ও অন্ধকার
তাদের চারপাশে থাকবে অগ্নিশিখা ও কালো ধোঁয়া, যা তাদের শ্বাস নিতে কষ্টকর করে তুলবে। (সূরা ওয়াকিয়া: ৪১-৪৪)
জাহান্নামের খাদ্য ও পানীয়
- যাক্কুম গাছ : অত্যন্ত তিক্ত ও ঘৃণ্য খাদ্য।
- গিসলিন : জাহান্নামীদের পুঁজ ও রক্ত। (সূরা হাক্কাহ: ৩৬-৩৭)
- ফুটন্ত পানি : তাদের মুখ ঝলসে দেবে ও কষ্ট বাড়াবে।
জাহান্নামের দরজা ও স্তর
আল্লাহ বলেন—
“জাহান্নামের সাতটি দরজা রয়েছে। প্রতিটি দরজার জন্য নির্দিষ্ট দল রয়েছে।” (সূরা হিজর: ৪৪)
- সবচেয়ে নিচের স্তর নির্ধারিত হয়েছে মুনাফিকদের জন্য।
- প্রতিটি স্তরে ভিন্ন ভিন্ন শাস্তি দেওয়া হবে।
জাহান্নামের প্রহরীরা
জাহান্নামের পাহারাদাররা কঠোর ও শক্তিশালী ফেরেশতা। কুরআনে উল্লেখ আছে—
“তার উপরে উনিশজন রয়েছে।” (সূরা মুদ্দাসসির: ৩০)
তারা কোনো দয়া করবে না, কেবল আল্লাহর নির্দেশ পালন করবে।
জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায়
- নামাজ কায়েম করা – এটি জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যে পার্থক্যকারী।
- আল্লাহর আনুগত্য – কুরআন-সুন্নাহর বিধান মেনে চলা।
- তাওবা ও ইস্তেগফার – নিয়মিত গুনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
- তাকওয়া অর্জন – আল্লাহভীরু জীবন যাপন।
- সৎকর্মে লিপ্ত হওয়া – দান-সদকা, সৎ কাজ প্রচার, অসৎ কাজ পরিহার।
জাহান্নামের কঠিন শাস্তি
ভূমিকা
- জাহান্নাম সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
- কেন আল্লাহ জাহান্নাম সৃষ্টি করেছেন
- জান্নাত ও জাহান্নাম – মানব জীবনের চূড়ান্ত গন্তব্য
অধ্যায় ১: জাহান্নামের অস্তিত্ব ও সৃষ্টি
- কুরআনে জাহান্নামের উল্লেখ
- হাদিসে জাহান্নামের বাস্তবতা
- ফেরেশতাদের মাধ্যমে জাহান্নামের নিয়ন্ত্রণ
অধ্যায় ২: জাহান্নামের ভয়ংকর দৃশ্য
- আগুনের তীব্রতা (কুরআন: সূরা আল-মুল্ক ৬-৭)
- জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর
- কালো ধোঁয়া ও অন্ধকার (সূরা আল-মুরসালাত ২৯-৩১)
অধ্যায় ৩: জাহান্নামের অধিবাসীরা কারা?
- কাফির ও মুশরিকরা
- মুনাফিকরা
- নামাজ ত্যাগকারীরা
- সুদখোর, ঘুষখোর, মদ্যপায়ী
- পিতামাতার অবাধ্য, হত্যাকারী, অপবাদদাতা প্রভৃতি
অধ্যায় ৪: জাহান্নামের শাস্তির ধরন
- আগুনে পুড়ানো
- ফুটন্ত পানি পান করানো (সূরা মুহাম্মদ ১৫)
- গলিত তামা পান করানো
- লোহার শৃঙ্খলে বেঁধে টেনে নেওয়া
- মুখ থেঁতলে দেওয়া (সূরা ক্বামার ৪৮)
- অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে দেওয়া
অধ্যায় ৫: জাহান্নামের খাদ্য ও পানীয়
- যাক্কুম গাছ (সূরা সফফাত ৬২-৬৬)
- গিসলিন (পুঁজ) (সূরা হাক্কা ৩৬-৩৭)
- ফুটন্ত পানি ও রক্তপুঁজ
অধ্যায় ৬: জাহান্নামের স্তরসমূহ
- কুরআনে বর্ণিত সাত দরজা (সূরা হিজর ৪৪)
- প্রতিটি স্তরে ভিন্ন ভিন্ন শাস্তি
- সবচেয়ে নিচের স্তর মুনাফিকদের জন্য নির্ধারিত
অধ্যায় ৭: জাহান্নামের প্রহরী
- ফেরেশতাদের সংখ্যা (১৯ জন – সূরা মুদ্দাসসির ৩০)
- প্রহরীদের কঠোরতা
- তাদের করুণা নেই, শুধু আদেশ পালন
অধ্যায় ৮: যারা জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবে
- মুত্তাকীরা
- নামাজ আদায়কারীরা
- তাকওয়াবান পুরুষ ও নারী
- আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যকারীরা
অধ্যায় ৯: জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায়
- সৎ আমল
- নামাজ প্রতিষ্ঠা
- কুরআন অনুসরণ
- গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা
- তাওবা ও ইস্তেগফার
জাহান্নামের আযাবের ভয়াবহতা
জাহান্নামের আযাব এত কঠিন ও ভয়ানক হবে যে, তার মুক্তিপণ হিসাবে দুনিয়ার সবকিছু দিতে পারলে তা দিয়ে জাহান্নামী মুক্তি কামনা করবে। মহান আল্লাহ বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ أَنَّ لَهُم مَّا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا وَمِثْلَهُ مَعَهُ لِيَفْتَدُوا بِهِ مِنْ عَذَابِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَا تُقُبِّلَ مِنْهُمْ ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
অর্থাৎ, যারা অবিশ্বাস করেছে পৃথিবীতে যা কিছু আছে, যদি তাদের তার সমস্ত থাকে এবং তার সাথে সমপরিমাণ আরো থাকে এবং কিয়ামতের দিন শাস্তি হতে মুক্তির জন্য পণস্বরূপ তা দিতে চায়, তবুও তাদের নিকট হতে তা গৃহীত হবে না এবং তাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি বর্তমান। (মাইদাহঃ ৩৬)
يَوَدُّ الْمُجْرِمُ لَوْ يَفْتَدِي مِنْ عَذَابِ يَوْمِئِذٍ بِبَنِيهِ (11) وَصَاحِبَتِهِ وَأَخِيهِ (12) وَفَصِيلَتِهِ الَّتِي تُؤْوِيهِ (13) وَمَن فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا ثُمَّ يُنجِيهِ (14)
অর্থাৎ, অপরাধী সেই দিনে শাস্তির বদলে দিতে চাইবে নিজ সন্তানসন্ততিকে। তার স্ত্রী ও ভাইকে। তার জ্ঞাতি-গোষ্ঠীকে, যারা তাকে আশ্রয় দিত। এবং পৃথিবীর সকলকে, যাতে এই মুক্তিপণ তাকে মুক্তি দেয়। (মাআরিজঃ ১১-১৪)
মহানবী (ﷺ) বলেন, “জাহান্নামের সবচেয়ে কম আযাবের একটি লোককে আল্লাহ তাবারাকা অতাআলা জিজ্ঞাসা করবেন, তোমার যদি দুনিয়া ও তন্মধ্যস্থিত সব কিছু হতো, তাহলে মুক্তিপণ হিসাবে তা দিয়ে কি মুক্তি নিতে?” সে বলবে, হ্যাঁ। আল্লাহ বলবেন, তুমি যখন আদমের পিঠে ছিলে, তখন আমি তোমার নিকট থেকে এর চাইতে সহজ জিনিস চেয়েছিলাম যে, তুমি শির্ক করো না, তোমাকে জাহান্নামে দেব না। কিন্তু তুমি শির্কই করেছ। (বুখারী, মুসলিম)।
জান্নাতের অবর্ণনীয় সুখ দেখে জান্নাতী যেমন দুনিয়ার সকল দুঃখ-ব্যথা ভুলে যাবে, তেমনি জাহান্নামের কঠিন আযাব দেখে জাহান্নামী দুনিয়ার সকল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিস্মৃত হবে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “কিয়ামতের দিন জাহান্নামীদের মধ্য হতে এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, যে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী ও বিলাসী ছিল। অতঃপর তাকে জাহান্নামে একবার (মাত্র) চুবানো হবে, তারপর তাকে বলা হবে, হে আদম সন্তান! তুমি কি কখনো ভাল জিনিস দেখেছ? তোমার নিকটে কি কখনো সুখ-সামগ্রী এসেছে? সে বলবে, না। আল্লাহর কসম! হে প্রভু! আর জান্নাতীদের মধ্য হতে এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, যে দুনিয়ার সবচেয়ে দুঃখী ও অভাবী ছিল। তাকে জান্নাতে (মাত্র একবার) চুবানোর পর বলা হবে, হে আদম সন্তান! তুমি কি (দুনিয়াতে) কখনো কষ্ট দেখছ? তোমার উপরে কি কখনো বিপদ গেছে?” সে বলবে, না। আল্লাহর কসম! আমার উপর কোনদিন কষ্ট আসেনি এবং আমি কখনো কোন বিপদও দেখিনি।” (মুসলিম)
জাহান্নামের কঠিন শাস্তি : হাদিসের আলোকে
ভূমিকা
দুনিয়ার জীবন একটি পরীক্ষা। মানুষ তার কর্ম অনুযায়ী আখিরাতে জান্নাত বা জাহান্নামের অধিবাসী হবে। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ-এর আনুগত্য করবে তারা জান্নাত পাবে, আর যারা অবাধ্যতা করবে তাদের স্থান হবে জাহান্নাম। হাদিসে জাহান্নামের শাস্তির ভয়াবহতা এতটাই স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, তা মানুষের অন্তরে ঈমান ও তাকওয়া জাগিয়ে তোলে।
কাফেরদের দেহের বিশালতা
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন—
- জাহান্নামে কাফেরের উভয় ঘাড়ের দূরত্ব হবে দ্রুতগামী অশ্বারোহীর তিন দিনের পথ।
- তাদের দাঁত হবে উহুদ পাহাড়ের সমান।
- গায়ের চামড়া হবে তিন দিনের পথ সমান পুরু।
(মুসলিম, মিশকাত হা/৫৪২৮)
জাহান্নামের উত্তাপ ও শীতলতা
হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত—
- যখন উত্তাপ বেড়ে যায় তখন নবীজি ﷺ জোহরের সালাত ঠাণ্ডা করে আদায় করতে বলতেন।
- তিনি বলেন, তোমরা যে গরম অনুভব কর তা জাহান্নামের গরম নিঃশ্বাসের কারণে এবং শীত অনুভব কর তা জাহান্নামের শীতল নিঃশ্বাসের কারণে।
(বুখারি, মিশকাত হা/৫৯১)
👉 এ থেকে বোঝা যায়, জাহান্নামে যেমন অতিমাত্রায় উত্তপ্ত আগুন রয়েছে, তেমনই রয়েছে প্রচণ্ড শীতলতার স্থান, যা শাস্তির মাধ্যম হবে।
কাফেরদের বসার স্থান
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন—
- কিয়ামতের দিন কাফেরদের রান বায়যা পাহাড়ের মতো মোটা হবে।
- তাদের বসার স্থান তিন দিনের পথ সমান প্রশস্ত হবে, যেমন মদিনা থেকে রাবায পর্যন্ত দূরত্ব।
(তিরমিযি, মিশকাত হা/৫৬৭৪)
অন্য বর্ণনায় এসেছে—
- কাফেরদের চামড়া হবে ৪২ হাত মোটা,
- দাঁত হবে উহুদ পাহাড়ের সমান,
- তাদের বসার স্থান হবে মক্কা-মদিনার মধ্যবর্তী দূরত্ব (৪১০ কিমি)।
(তিরমিযি, মিশকাত হা/৫৬৭৫)
জাহান্নামিদের বিশাল আকার
একজন জাহান্নামির—
- দাঁত উহুদ পাহাড়ের সমান,
- চামড়া ৪২ হাত মোটা,
- বসার স্থান প্রায় আড়াইশ মাইল।
অন্য হাদিসে নবীজি ﷺ বলেছেন—
প্রতি হাজারে ৯৯৯ জন জাহান্নামে যাবে এবং প্রতিজনের বসার স্থান প্রায় ২৫০ মাইল হবে।
জাহান্নামে জিহ্বার শাস্তি
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত—
- জাহান্নামে কাফেরদের জিহ্বা হবে এক থেকে দুই ফারসাখ (তিন মাইল) দীর্ঘ।
- মানুষেরা তাদের জিহ্বার উপর দিয়ে হাঁটাচলা করবে।
(তারগিব ওয়া তারহিব, আহমাদ, তিরমিযি)
উপসংহার
জাহান্নামের শাস্তি এত ভয়াবহ যে মানুষের হৃদয় কেঁপে ওঠে। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে এর শাস্তি থেকে হেফাজত করুন এবং জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমিন
0 Comments