হিজরি তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীর সংযোগস্থলে যে কজন ক্ষণজন্মা মনীষী ইলমে হাদিস ও ইলমে ফিকহের সমন্বয়ে ইসলামী জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছেন, তাঁদের অন্যতম ইমাম আবু জাফর তাহাবি (রহ.)। যিনি ছিলেন একাধারে একজন মুহাদ্দিস ও ফকিহ। ইলমে হাদিসের জটিল সমস্যা নিরসনে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।
তাঁর মূল নাম আহমাদ, উপনাম আবু জাফর। পিতার নাম মুহাম্মদ। বংশ পরম্পরা হলো আবু জাফর আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সালামা ইবনে আব্দুল মালিক আল-আজদি আত-তাহাবি।
প্রাচীন মিসরের ‘ত্বহা’ নামক গ্রামে, ২৩৯ হিজরি সনে এ মহান মনীষী, জ্ঞানপিপাসু ও এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
বাল্যকালে তিনি তাঁর মামা ইমাম মুজানি (র.)-এর কাছে লালিত-পালিত হন এবং তাঁর কাছেই শাফেয়ি ফিকহ অধ্যায়ন করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি মিসর, সিরিয়া, বায়তুল মুকাদ্দাস ও অন্য অঞ্চল সফর করে হানাফি ফিকহ এবং হাদিস শাস্ত্রের গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। এবং হানাফি ফিকহের প্রতি আকৃষ্ট হন। গ্রহণ করেন হানাফি মাজহাব। জানা যায়, এজন্য তার মামা একদিন ইমাম মুজানি বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কসম! তোমার দ্বারা কিছুই হবে না।’ পরবর্তীতে ইমাম তাহাবি যখন বড় ইমাম হলেন, তখন বলেছিলেন, আল্লাহ আমার মামার প্রতি রহম করুন, তিনি জীবিত থাকলে তার কসমের কাফফারা দিতেন।
এ মহান মনীষী তাঁর জীবদ্দশায় বহু কালজয়ী গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। যা হাদিস ও ফিকহের এক অপূর্ব সমন্বয়। তার মধ্যে উল্লেখযাগ্য হলো ‘শরহু মাআনিল আসার’। এটি মাদরাসাগুলোতে দাওরায়ে হাদিস ও কামিল শ্রেণির পাঠ্যভুক্ত একটি কিতাব। রচনা করেছেন শরহু মুশকিলুল আসারসহ আরো অসংখ্যা কিতাব।
অবশেষে, যুগশ্রেষ্ঠ এই ফিকহশাস্ত্রবিদ, আলোড়ন সৃষ্টিকারী জ্ঞানসাধক আবু জাফর তাহাবি (রহ.) বিশ্ববাসীকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ৩২১ হিজরিতে ৯২ বছর বয়সে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যান।
মিসরের কায়রোতে অবস্থিত বিখ্যাত আল-কারাফা কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
‘শরহু মাআনিল আসার’-এর পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘শরহু মাআনিল আসার’ হাদিস ও ফিকহের এক অপূর্ব সংযোজন। সাধারণত সিহাহ সিত্তাহ বা অন্যান্য সুনান গ্রন্থে হাদিস সংকলনের দিকে জোর দেওয়া হয়। কিন্তু ইমাম তাহাবি (রহ.) তাঁর কিতাবে হাদিস উল্লেখ করার পাশাপাশি উদ্ভাবন করেছেন, ফিকহি মাসআলা। নিরসন করেছেন হাদিসের বাহ্যিক বিরোধ। পাশাপাশি হানাফি ফিকহের দলিলগুলো অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন করেছেন। ফলে সুনান গ্রন্থগুলোর মাঝে এটি স্বতন্ত্র ও মর্যাদাপূর্ণ একটি অবস্থান তৈরি করেছে।
পরবর্তী মুহাদ্দিস ও ফকিহরা এই কিতাবের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, হাদিসের চয়ন-বিন্যাস ও রচনাশৈলীর দিক থেকে এটি ‘সুনানে আবু দাউদ’ ও ‘সুনানে নাসায়ি’-এর সমকক্ষ। ফিকহুল হাদিসের ক্ষেত্রে এর কোনো তুলনা হয় না। এই কিতাব রচনায় তিনি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের আশ্রয় নিয়েছেন। যেখানে তিনি প্রথমে প্রতিপক্ষের দলিল, এরপর নিজের পক্ষের দলিল এবং শেষে নজর বা যুক্তির মাধ্যমে সামঞ্জস্য বিধান করেন। এবং অন্য সুনান গ্রন্থের তুলনায় এই কিতাবেও ‘নাসিখ’ (রহিতকারী) ও ‘মানসুখ’ (রহিত) হাদিসগুলো অত্যন্ত চমত্কারভাবে বিন্যস্ত করেছেন। তুলে এনেছেন রিজাল শাস্ত্রের আলোচনাও। প্রতিটি হাদিসের সনদ ও রাবিদের (বর্ণনাকারীদের) সমালোচনা ও পর্যালোচনা করেছেন, যা একে উচ্চমানের ইলমি কিতাবের মর্যাদা দিয়েছে। যেখানে তিনি মারফু, মাওকুফ এবং আসারের অন্তর্ভুক্ত প্রায় ২২ হাজার ২৪০ টি হাদিস সংকলন করেছেন।
হানাফি মাজহাব সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
-%E0%A6%8F%E0%A6%B0-%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AE.jpg)




0 Comments